ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ: ঢাকার যানজট কমাতে নতুন পরিকল্পনা:
নবজাগরণ প্রতিবেদক:
ঢাকার যানজট কমাতে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আনতে চায় সরকার। এরই অংশ হিসেবে সড়ক ব্যবহারে মাশুল আরোপের সুপারিশ করেছে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ-সংক্রান্ত সরকারি টাস্কফোর্স। পাশাপাশি সহজ শর্তে গাড়ি কেনার ঋণ সীমিত করা এবং অবৈধ পার্কিংয়ের জরিমানা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যানজট, বায়ুদূষণ ও পরিবহন অব্যবস্থাপনা রোধে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে গণপরিবহনকে আধুনিক ও সহজলভ্য করতে পারলেই ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নির্ভরতা কমবে।
সড়কে মাশুল, গাড়ি কেনার ঋণ সীমিত করার প্রস্তাব:
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হকের নেতৃত্বে করা প্রতিবেদনে ব্যক্তিগত গাড়ি কমানোর জন্য বেশ কিছু সুপারিশ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
১. সড়ক ব্যবহারে মাশুল নির্ধারণ: বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মতো সড়কের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অর্থ ব্যয় করতে হবে। এতে অপ্রয়োজনীয় গাড়ি চলাচল কমে আসবে।
২. গাড়ি কেনার ঋণ সীমিতকরণ: সহজ শর্তে ব্যাংক থেকে গাড়ি কেনার ঋণ দেওয়া নিরুৎসাহিত করতে হবে, যাতে অপ্রয়োজনীয় গাড়ির সংখ্যা না বাড়ে।
৩. অবৈধ পার্কিংয়ের জরিমানা বৃদ্ধি: ঢাকার রাস্তায় অবৈধভাবে পার্কিং করা গাড়ির সংখ্যা ব্যাপক। কঠোর জরিমানার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
রাইড শেয়ারিং ও ছোট যানবাহনের ওপর নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ:
রাইড শেয়ারিং সেবার ওপর আরও নিয়ন্ত্রণ আনতে বলেছে টাস্কফোর্স কমিটি। বিশেষ করে ব্যাটারিচালিত রিকশা, লেগুনা ও দুরন্তর মতো যানবাহনের চলাচল বন্ধের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর পরিবর্তে রাজধানীতে বড় ও দ্বিতল বাসের সংখ্যা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকায় যাত্রীদের জন্য নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ গণপরিবহন নিশ্চিত না করতে পারলে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমানো সম্ভব হবে না।
উড়ালসড়ক নির্মাণ বন্ধ ও গণপরিবহন সম্প্রসারণের সুপারিশ:
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকায় বর্তমানে অবকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনা যথাযথভাবে হয়নি, ফলে "জট লাগানো উন্নয়ন" হচ্ছে। এর ফলে খরচ বাড়লেও কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না।
🔹 উড়ালসড়ক নির্মাণ বন্ধ: এখনই ঢাকার ভেতরে নতুন উড়ালসড়ক নির্মাণ না করে গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
🔹 বিকল্প ব্যবস্থা: শহরের বাইরে উড়ালসড়ক ও উড়াল রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে, যাতে কৃষিজমির ক্ষতি কম হয়।
চার মন্ত্রণালয় একত্র করার প্রস্তাব:
দেশের পরিবহন ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করতে সড়ক, রেল, নৌ ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়কে একত্র করার প্রস্তাব দিয়েছে টাস্কফোর্স। কারণ আলাদা মন্ত্রণালয়ের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে সমন্বয়ের অভাব দেখা দেয়।
একাধিক প্রকল্প জমি অধিগ্রহণজনিত সমস্যার কারণে থমকে আছে, যার উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী কনটেইনার টার্মিনাল ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কথা।
রাজধানী স্থানান্তরের সুপারিশ:
টাস্কফোর্সের মতে, ঢাকার ৮৫ শতাংশ অবকাঠামো অননুমোদিত, যা নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এছাড়া যানবাহনের গড় গতিবেগ ১৯৯৭ সালে যেখানে ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার ছিল, তা এখন আরও কমে গেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন শহরের উন্নয়ন কৌশল বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে রাজধানী ঢাকার বাইরে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত।
গণপরিবহন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর সুপারিশ:
একটি সমন্বিত গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার তাগিদ দিয়েছে টাস্কফোর্স। এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে—
🚆 মেট্রোরেল ও সাব-আরবান কমিউটার রেল
🚋 ট্রাম ও এলআরটি (লাইট রেল ট্রানজিট)
🚍 বিআরটি (বাস র্যাপিড ট্রানজিট) ও বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ
🚖 রাইড শেয়ারিং সেবা
কঠিন সিদ্ধান্ত নিলে সুফল মিলবে:
অধ্যাপক সামছুল হক মনে করেন, ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ ও গণপরিবহন উন্নত করতে হলে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। শক্ত রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, "বিশ্বের বহু দেশ এসব কৌশল প্রয়োগ করে সুফল পেয়েছে। বাংলাদেশও যদি একই পথে হাঁটে, তাহলে ঢাকাকে বসবাসযোগ্য ও যানজটমুক্ত করা সম্ভব হবে।"
উপসংহার:
যানজট ও পরিবহন অব্যবস্থাপনা ঢাকার অন্যতম প্রধান সমস্যা। ব্যক্তিগত গাড়ির লাগাম টেনে ধরা, গণপরিবহন সম্প্রসারণ, উড়ালসড়কের পরিবর্তে পরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়ন এবং মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়ের মাধ্যমে এর সমাধান সম্ভব।
কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে হলে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কার্যকর বাস্তবায়ন। নতুবা ঢাকার যানজট কমার বদলে আরও বাড়বে, আর নগরবাসীর দুর্ভোগ চলতেই থাকবে।